আনোয়ার হোসেন, গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধিঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর অশোক কুমার চাকরির পেছনে অনেক ছুটেছেন, কিন্তু ভাগ্যে জোটেনি চাকরি। পরে তিনি ঝুঁকে পড়েন মরিচসহ সবজি চাষে। ইউটিউব দেখে মরিচের উচ্চফলনশীল জাত খুঁজে পান। প্রথমে ‘মালচিং পেপার’ পদ্ধতিতে এক বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করে ৮০ হাজার টাকা লাভ করেন। কৃষিতে মনোযোগ বাড়ে তাঁর। মরিচের পাশাপাশি শুরু করেন সবজি ও ঘাস চাষ। এতে প্রতি মাসে তাঁর আয় হয় ২০–২৫ হাজার টাকা। বেকারত্বকে দূরে ঠেলে তিনি এখন সফল কৃষি উদ্যোক্তা।
গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে ছোট গয়েশপুর গ্রামে অশোক কুমার (৩০) এর বাড়ি। সাদুল্যাপুর উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত এই গ্রামটি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গ্রামের নিভৃত ও নির্জন পরিবেশে অশোক কুমারের সবজি খামার। জমিজুড়ে মরিচের গাছ। পাশেই পুঁইশাক ও নেপিয়ার ঘাস, যেন সবুজের সমারোহ। ছবি তুলতে গেলে হাসিমাখা মুখে অশোক কুমার বললেন, জমিতে কাজ করতে গেলে আনন্দে বুক ভরে যায়। লাভের জন্য নয়, সমন্বিত কৃষির প্রতি তাঁর যথেষ্ট আকর্ষণ।
কথায় কথায় অশোক কুমার জানান, পৈতৃক সূত্রে সাত বিঘা জমি পেয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচ বিঘায় সবজি চাষ ও দুই বিঘা জমিতে ধানের চাষ করছেন। সবজির মধ্যে মরিচ এক বিঘা, পটোল এক বিঘা, চিচিঙ্গা এক বিঘা, পুঁইশাক এক বিঘা ও নেপিয়ার ঘাস এক বিঘা। ইউটিউবে ২০২১ সালে অশোক উন্নত জাতের মরিচের সন্ধান পান। এক বিঘা জমিতে ‘বিজলী প্লাস ২০২০’ জাতের মরিচ চাষ করেন। পরিবেশবান্ধব মালচিং পেপার ব্যবহার করে এ জাতের মরিচ চাষ করেন। খরচ পড়ে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। প্রথমবারই তিনি খরচ বাদে ৮০ হাজার টাকা লাভ করেন।
মালচিং পদ্ধতিতে এ জাতের মরিচ একবার লাগালে বছরের ৯ মাস ফলন পাওয়া যায় উল্লেখ করে অশোক জানান, প্রতি বিঘায় ২০ থেকে ২৫ মণ মরিচ উৎপাদন হয়। চলতি বছরের মার্চে এক বিঘায় এ জাতের মরিচ লাগান। ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মরিচ বিক্রি করেন ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। আরও ২০ হাজার টাকার বিক্রি করতে পারবেন। মরিচের লাভ দেখে পাশাপাশি সবজি ও নেপিয়ার ঘাস চাষ শুরু করেন তিনি।
সাদুল্যাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মতিউল আলম বলেন, পরিবেশবান্ধব মালচিং পেপার ব্যবহার করে চাষ করা মরিচ খাদ্যগুণ সমৃদ্ধ। মালচিং পেপার ব্যবহারের ফলে মরিচের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এটি গাছের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং ফলন বাড়ায়। কৃষক লাভবান হয়। মরিচ চাষে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, মরিচ চাষে মালচিং পেপার ব্যবহারে দ্বিগুণ ফলন পাওয়া যায়। এ পদ্ধতি গাছকে অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও অতিবৃষ্টি থেকে রক্ষা করে। আগাছা দমন করে এবং মাটির আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। প্রথমেই জমিতে পর্যাপ্ত জৈব ও রাসায়নিক সার দিয়ে চাষ করতে হয়। পরে দেড় থেকে ২ ফুট ফাঁকা রেখে জমিতে ৮-১২ ইঞ্চি পরিমাণ উঁচু করে মাটির বেড তৈরি করা হয়। মালচিং পেপারের কালো রঙের দিকটা নিচের দিকে এবং সিলভার রঙের দিকটা থাকে ওপরের দিকে। নির্দিষ্ট দূরত্বে গোল করে কেটে নিতে হয়। কেটে নেওয়া জায়গাটিতে বীজ বা চারা রোপণ করতে হয়।
মা শেফালী রানী ও স্ত্রী তৃপ্তি রানীকে নিয়ে অশোকের সংসার। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। তিনি ২০০৯ সালে সাদুল্যাপুর উপজেলার ইদ্রাকপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ২০১১ সালে জয়নপুর আদর্শ কলেজ থেকে এইচএসসি, ২০১৪ সালে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয় স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করেন। একই বিষয়ে ২০১৮ সালে বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর করেন।
অশোক কুমার বলেন, ‘একজন বেকার যুবক চাকরির জন্য যে সময় ব্যয় করেন, সেই সময়ে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করলে চাকরির চেয়ে বেশি লাভবান হতে পারবেন। আমি তার প্রমাণ।’ ধানের চেয়ে সবজি চাষে আয় বেশি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘উন্নত পদ্ধতিতে ফসলের চাষ করলে কৃষিবিপ্লব ঘটানো সম্ভব। তাই ভবিষ্যতে সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তুলতে চাই।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক খোরশেদ আলম জানান, মালচিং পেপার ব্যবহারের ফলে মরিচ চাষে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। এ বছর জেলায় ৪ হাজার ১২৫ বিঘা জমিতে মরিচ চাষ হয়েছে। এর মধ্যে মালচিং পদ্ধতিতে জেলায় ১৩৫ বিঘা জমিতে উচ্চফলনশীল জাতের মরিচ চাষ হয়েছে। এসব জমি থেকে সম্ভাব্য কাঁচা মরিচ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ১৬৮ মেট্রিক টন।