আনোয়ার হোসেন, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টারঃ হারানো ঐতিহ্য নিয়ে লিখতে মনের সত্তায় কৌতুহল জাগে। লেখার অভিজ্ঞতা কম থাকায় কি ভাবে লিখবো এমন চিন্তা মাথায় নিয়ে কলম ধরে বসেই থাকি। কলম কি চলবে না? মন চায়
ভাঙা-ভাঙা শব্দে হোক না একটু লেখা! তাই লিখছি।
পৃথিবীতে প্রতিদিন কিছু না কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো সেটা বুঝে উঠা যাচ্ছে না। তার পরও নীরবে, নিভৃতে, নিঃশব্দে হারিয়েই যাচ্ছে। এভাবে হারাতে হারাতে জীবন কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ জানে না। কেউ বোঝে না। বরং সেটা অজ্ঞাতেই থেকে যেতে বেশি ভালোবাসে। তবে একবার যা হারিয়ে যায় তা আর কখনো ফিরে পাওয়া যায় না। পৃথিবীতে হারানো খুব সহজ, খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। যারা মরে যায়, তাদের আর কখনো ফিরে পাওয়া যায় না। প্রকৃতির এটাই নিয়মে। বলছিলাম,
গাইবান্ধার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ির কথা।
‘ও কি গাড়িয়াল ভাই, কত রবো আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে…’গ্রাম-বাংলার সেই চিরচেনা গান এখনও শোনা যায়। গ্রাম-বাংলার আঁকাবাঁকা মেঠো পথে ধীরে ধীরে চলা ঐতিহ্যবাহী সেই গরুর গাড়ি আর দেখা যায় না। কালের বির্বতনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার জনপ্রিয় গরুর গাড়ি এখন শুধুই স্মৃতি বহন করে!
আগে গরুর গাড়িতে চড়ে বর-বধূ যেত। গরুর গাড়ি ছাড়া বিয়ে হতো না। বিয়ে বাড়ি বা মাল পরিবহনে গরুর গাড়ি ছিল একমাত্র পরিবহন বাহন। বরপক্ষের লোকজন বরযাত্রী ও ডুলিবিবিরা বিয়ের জন্য ১০ থেকে ১২টি গরুর গাড়ির ছাওনি (টাপর) সাজিয়ে শ্বশুরবাড়ি ও বাবার বাড়ি আসা-যাওয়া করত। রাস্তাঘাটে গরুর গাড়ি থেকে পটকাও ফুটাত। যে সব পরিবারে গরুগাড়ি ছিল, তাদের কদরের সীমা ছিল না। কৃষকরা প্রতিদিন ফজরের আজানের আগে গরুর গাড়িতে কখনো জৈব সার তথা গোবরের সার, কখনো গরুর খাবার ও লাঙ্গল-মই-জোয়াল নিয়ে যেত মাঠে। গাইত উঁচু সুরে, ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রবো আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে…..।’ গরুর গাড়ির চালককে বলা হতো গাড়িয়াল।
আর তাই চালককে উদ্দেশ্য করে রচিত হয়েছে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ কিংবা ‘আস্তে বোলাও গাড়ি, আরেক নজর দেখিয়া নাও মুই দয়ার বাপের বাড়িরে গাড়িয়াল’ এরকম যগান্তকারী সব ভাওয়াইয়া গান।
গরু গাড়ি দুই চাকাবিশিষ্ট গরু বা বলদে টানা এক প্রকার বিশেষ যান। এ যানে সাধারণত একটি মাত্র অক্ষের সাথে দু’টি চাকা যুক্ত থাকে। গাড়ির সামনের দিকে একটি জোয়ালের সাথে দুটি গরু বা বলদ জুটি মিলে গাড়ি টেনে নিয়ে চলে। সাধারণত চালক বসেন গাড়ির সামনের দিকে। আর পেছনে বসেন যাত্রীরা। বিভিন্ন মালপত্র বহন করা হয় গাড়ির পেছন দিকে। বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য ও ফসল বহনের কাজেও গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল ব্যাপক।
গরুর গাড়ির একটি সুবিধা হলো, এতে কোনো জ্বালানি লাগে না। ফলে ধোঁয়া হয় না। পরিবেশের কোনো ক্ষতিও করে না। এটি পরিবেশবান্ধব একটি বাহন।
তবে বর্তমানে নানা ধরনের মোটরযানের কারণে অপেক্ষাকৃত ধীর গতির এই যানটির ব্যবহার অনেক কমে এসেছে। তাই এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। বর্তমান যুগ হচ্ছে যান্ত্রিক যুগ।
অনুমান করা হয়, খ্রিস্টজন্মের এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৫০০ বছর আগেই সিন্ধু অববাহিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল, যা সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে দক্ষিণেও ছড়িয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন জনপ্রিয় উপন্যাসেও দক্ষিণ আফ্রিকার যাতায়াত ও মালবহনের উপায় হিসেবে গরুর গাড়ির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ‘এইচ রাইডার হ্যাগার্ড’-এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘কিং সলোমনস মাইনস’ নামক উপন্যাসেও গরুর গাড়ি সম্বন্ধে বর্ণনা রয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাতে রাতে বিশ্রাম নেয়ার সময় বা বিপদে পড়লে তারা প্রায় গরুর গাড়িগুলোকে গোল করে সাজিয়ে এক ধরনের দুর্গ গড়ে তুলে তার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করত। চেঙ্গিস খানের নাতি বাতু খানের নেতৃত্বে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে যে মোঙ্গল আক্রমণ চলে সেখানে তার প্রতিরোধে স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা গরুর গাড়ির ব্যবহার করা হয়েছিল।
গাইবান্ধার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গ্রামবাংলার জনপ্রিয় এই গরুর গাড়ি এখন আর দেখা যায় না। এখন এসব বাহন রূপকথার গল্পমাত্র এবং বিলুপ্ত হয়ে স্থান পেয়েছে সংবাদপত্র আর বইয়ের পাতায়।