আমিনুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ:
মানিকগঞ্জে ২ হাতুরে ডাক্তারের অপচিকিৎসায় এক প্রসূতির অকাল মৃত্যু হয়েছে।
হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ৪ লক্ষ টাকায় রফাদফার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে। এলাকায় চলছে নানা গুনঞ্জন। মৃত মহিলা মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বেতিলা মিতরা ইউনিয়নের পালড়া এলাকার অষ্টদানা গ্রামের জ্যোতিনের স্ত্রী।
জানাগেছে, গত মঙ্গলবার মৃত সুবিতা রানী প্রসব বেদনা নিয়ে পালরা বাজারের কাঙ্গালী মার্কেটের হাতুরে ডাক্তার রাসেলের কাছে চিকিৎসা নিতে যায়। রাসেল কোন প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই কাঁচের বোতলের একটি স্যালাইন সবিতা রানীর শরীরের পুশ করে। এর কিছুক্ষণ পর সবিতা মৃত বাচ্চা প্রসব করে। পরের দিন বুধবার সকালে সবিতার প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হলে পুনরায় পাশের মিতরা বাজারের আরেক ডাক্তার সামসুল হককে অন কলে বাড়িতে নিয়ে আসে।
কথিত ওই ডাক্তারও রোগীকে আরেকটি স্যালাইন পুশ করে। এতে সবিতার পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ ধারণ করে। অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে রেফার্ড করেন শামসুল হক। ঘন্টাখানেক পর স্বামী জ্যোতিন সুবিতাকে মানিকগঞ্জ ২৫০ শষ্যা হাসপাতালে নিয়ে যায়। রোগীর অবস্থা আশংকাজনক দেখে ওই হাসপাতালের ডাক্তার রোগীকে মানিকগঞ্জ কর্নেল মালেক মেডিকেলে রেফার্ড করেন।
ওখানে নেয়ার পর ওই হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঢাকা মেডিকেলে পৌছানোর পর সবিতার মৃত্যু হয়।
স্থানীয়রা জানান, হাতুরে ডাক্তার রাসেল ঔষধ কোম্পানীতে চাকুরি করার সুবাদে পালরা বাজারে ঔষধের দোকানের পাশাপাশি রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। ডাক্তার না হয়ে প্রসূতি রোগীকে মনগড়া চিকিৎসা দেয় রাসেল। তার ভুল চিকিৎসার কারণে অকালেই প্রাণ দিতে হলো সবিতার ও তার নবজাতকের।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক পাশের দোকানি জানান, রাসেল খামখেয়ালি করে ওই মহিলাকে চিকিৎসা দিয়েছে। ওই তো ডাক্তার না। বাপের চাউলের দোকানের সাথে দোকান ভাড়া নিয়ে ঔষধ বিক্রি শুরু করেছে। রাসেল ডাক্তার হবে কেন? ডাক্তার হতে গেলে পড়ালেখা করে ড্রিগ্রী লাগে। ওই তো দেখি কোন একটা ঔষধ কোম্পানীতে চাকুরী করে। ডাক্তারি করতে গিয়ে তো এখন পালিয়ে রয়েছে।কয়েকদিন ধরে দোকানে আসে না। শুনেছি টাকা দিয়ে স্থানীয় মেম্বারের মাধ্যমে মিমাংসা করেছে।
সুবিতার স্বামী জ্যোতিন বলেন, রাসেল আমার স্ত্রীকে স্যালাইন দিয়েছিল। তারপরের দিন সামসুল ডাক্তারও একটা স্যালাইন দিয়েছিল। এর বেশি কিছু আমি জানি না। আমার চাইতে ভালো জানে আমার বাড়ির পাশের কাকি। এই প্রতিবেদকে তিনি বলেন আপনি তাকে ফোন করে জানেন।
পাশের বাড়ি নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, আমি সব জানি ভালো ভাবে। রাসেল রোগীকে একটা স্যালাইন দিয়েছিল। এরপর রোগীর মৃত বাচ্চা প্রসব হয়। পরে রোগীর প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হলে মিতরা বাজারের সামসুল ডাক্তার এসে রোগীকে আরেকটি স্যালাইন দেয়। ওই স্যালাইন শেষ না হতেই রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটে। পরে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিলে ওখানে ভর্তি না করে ডাক্তার কর্নেল মালেক মেডিকেলে পাঠায়।
ওই জায়গার ডাক্তারও পরে ঢাকা মেডিকেলে পাঠায়। পরে রোগীর ঢাকায় মৃত্যু হয়। এলাকায় কোন বিচার শালিশ হয়নি। কারো কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নেয়া হয়নি। এই পরিবারটা সহজ সরল অশিক্ষিত। রোগী অল্প সময়ে বারবার বাচ্চা জন্ম দেয়া শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এখানে কাউকে দোষ দেয়ার কিছু নেই। ডাক্তার রাসেলের দোকান বন্ধ কেন জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, রাসেলের শাশুড়ি অসুস্থ তাই দোকান বন্ধ। আর এরকম একটা গুজব ছড়ানোর পর স্বাভাবিক ভাবেই লজ্জার ভয়ে দোকানে আসে না।
বেতিলা মিতরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড সদস্য সাগর আহম্মেদ সাবু মেম্বার বলেন, জ্যোতিনের স্ত্রী ঢাকায় হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেছে। রাসেল তাকে চিকিৎসা দিয়েছে এমন কথা আমি শুনি নাই।
৪,৫,৬ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার রহিমা বেগম বলেন, জ্যোতিনের স্ত্রী মারা গেছে এতোটুকু জানি। আমাকে ফোন করে থানায় যেতে বললো। আমি মানিকগঞ্জ থানায় যাওয়ার পর শুনি ঢাকায় যেতে হবে। ঢাকায় গিয়ে স্বাক্ষর দিয়ে লাশ গ্রামে এনেছি। পরে টাকা পয়সার লেনদেন হয়েছে কি’না আমার জানা নেই।
এপ্রসঙ্গে ডাক্তার সামসুল হক বলেন, রোগীর প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হওয়ায় আমি রোগীকে শুধু স্যালাইন দিয়েছে। এরপর আমি মানিকগঞ্জ সদরে রেফার্ড করি। যদি চিকিৎসা ভুল হয়ে থাকে তাহলে রাসেল ডাক্তার ভুল চিকিৎসা দিয়েছে। রাসেল রোগীকে কাচের বোতলের স্যালাইন দিয়েছে।
তার দাবি তিনি সব ধরনের চিকিৎসা দিতে পারেন। তিনি রেজিস্ট্রার প্রাপ্ত ডাক্তার। নামের আগে ডাক্তার লেখার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, সবাই লিখে, আমিও লিখি।
এব্যাপারে সরেজমিনে গিয়ে ডাক্তার রাসেলের দোকান বন্ধ পাওয়া যায়। পাশের দোকান থেকে তার মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে তাকে একাধিকার ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেনি।
এবিষয়ে মানিকগঞ্জ সিভিল সার্জন ডাঃ মোয়াজ্জেম আলী খান চৌধুরী বলেন, কোন পল্লী চিকিৎস এধরনের চিকিৎসা দিতে পারে না। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার এবিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে। আমাদের কাছে অভিযোগ দিলে আমরাও আইনুনগ ব্যবস্থা নিব।