মোহাম্মদ জুয়েল রানা,স্টাফ রিপোর্টার -ব্রাক্ষণবাড়িয়া:
ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতের এক অনিবার্য নাম ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তিনি তাঁর দীর্ঘ সংগীতজীবনে তৈরি করেছেন হাজার হাজার শিষ্য। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অর্জন করেছেন অজস্র সম্মাননা, পুরস্কার, পদবি। ব্রিটিশ সরকার উপাধি দিয়েছিলেন ‘খাঁ সাহেব’ আর রানি এলিজাবেথের দেওয়া খেতাব ছিল ‘সুরসম্রাট’। দেশে দেশে তাঁর ভক্তরা তাঁকে ‘বাবা’ বলেই সম্বোধন করেন। এই শাস্ত্রীয় সংগীত সাধক বিশ্বজোড়া খ্যাতির শিখরে গেলেও, নিজ গ্রামে তিনি রয়ে গেছেন উপেক্ষিত।
আলাউদ্দিন খাঁর জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে। তিনি এই গ্রামে ১৮৬২ সালের ৮ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর সংগীত সাধনার বড় অংশ কাটে ভারতের মধ্য প্রদেশের মাইহারে। ওস্তাদ ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যু বরণ করলে, সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
গত সপ্তাহে (৩০ আগস্ট) শিবপুরে আলাউদ্দিন খাঁর বসত বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় খুবই জীর্ণ শীর্ণ দশা। বাড়ির কোথাও এই বিশ্ব বরেণ্য সংগীত সাধকের স্মৃতি চিহ্নের কোন লেশমাত্র নেই। ওই বাড়িতে আলাউদ্দিন খাঁর সন্তানেরা কেউ বসবাস করেন না। তবে ওখানে এখন বসবাস করছেন আলাউদ্দিন খাঁর বংশীয় আত্মীয় ইদ্রিস খানের (৬৪) পরিবার। ইদ্রিস খান নিজের পরিচয় দিলেন আলাউদ্দিন খাঁনের বড় ভাই আফতাব উদ্দিন খাঁর মেয়ের ছেলের ছেলে। তাঁর ভাষায় তিনি, ‘ওস্তাদের ভাইয়ের নাতির ঘরের পুতি’।
ইদ্রিস খান বাড়ির পুকুরের পাড় দেখিয়ে জানালেন, এই পুকুর পাড়েই ছিল ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর দুই তলা কাঠের বসত ঘর। এখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব কৈশোরের বড় একটি অংশ। সেই বসত ভিটার অস্তিত্ব এখন আর নেই। মুক্তিযুদ্ধের পরে এক ঘূর্ণিঝড়ে ঘরটি ভেঙে পড়লে, ওস্তাদের ভাই ছমির উদ্দিন খাঁর নাতি লাউ খান ঘরের কাঠ, টিন সব নিয়ে যায়। এখন ভিটার অর্ধেকটা ভেঙে পড়েছে পুকুরে, বাকি অর্ধেকে রান্না ঘর করছেন শামসুউদ্দিন ও শামীমা দম্পতি। ঝোপঝাড় পরিপূর্ণ স্থানটিকে দূর থেকে দেখলে যে কারও কাছে পরিত্যক্ত জায়গা মনে হতে পারে। শামীমা বেগম জানালেন, কোথাও জায়গা না থাকায় আশ্রিতা হিসেবে ২২ বছর ধরে এই জায়গাতে বসবাস করছেন তাঁরা। তিনি আলাউদ্দিন খাঁর নাম শুনেছেন। তবে ওস্তাদ আলাউদ্দিন কি কারণে বিখ্যাত সেটা তিনি জানেন না। অথচ এই বসত ভিটা দেখতে জার্মান, ভারত, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়াসহ নানা দেশ থেকে ওস্তাদের ভক্তরা শিবপুর গ্রামে আসে।
ওস্তাদ নিজ গ্রামে অবহেলিত এ বিষয়ে আক্ষেপ জানিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা উদীচীর সভাপতি জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন বলেন, ‘তিনি যে মাপের সংগীতজ্ঞ। এত বড় মাপের প্রতিভাকে ওনার গ্রামে কেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়ও ধারণ করার মতো তেমন মানুষ নেই। যারা সাংস্কৃতিক সচেতন তাদের মধ্যেও ভাবনার জায়গা ওভাবে তৈরি হয়নি।’
সুরসম্রাটের স্মৃতি রক্ষার্থে শিবপুরে গড়ে উঠেছে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি সংসদ। সংগঠনের সভাপতি রানা শামীম রতন বলেন, ‘১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর যখন খাঁ সাহেব মারা যান, তখন আমি দশম শ্রেণির ছাত্র। দেশি বিদেশি মিডিয়া এটা অনেক গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। সুর সাধনায় তিনি যে খ্যাতি অর্জন করছেন তা বিস্ময়কর।’
ভারতের মধ্য প্রদেশের মাইহারে ওস্তাদের সমাধি দেখতে গিয়েছিলেন স্মৃতি সংসদের এই নেতা। তিনি বলেন, ‘ওস্তাদ উপমহাদেশে গৌরব বয়ে এনেছে। তাঁর সমাধিতে দেখতে ১৯৯৭ সালে মাইহার শহরে গিয়েছি। ওখানে একটা জাদুঘর রয়েছে। তাতে রাখা আছে ওস্তাদের সুরের যন্ত্রপাতি। ওস্তাদের অনুসারীরা আমাকে ‘বাবার বাড়ির লোক’ বলে সম্বোধন করেছে। তাঁদের সম্মান, শ্রদ্ধা, ভক্তি দেখে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। তাঁরা আবদার করেছিলেন বাবার বসত বাড়ির মাটি যেন তাদের জন্য পাঠাই। পরে পাঠিয়েছিলাম।’
নিজ গ্রামে ওস্তাদের উপেক্ষিত হওয়ার কারণ হিসেবে শামীম রতন জানান, ওস্তাদ পরিবারে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। তাঁর উত্তরসূরি কেউ নেই। এখানে তাঁর ভাতিজা ঘরের নাতিপুতি ওস্তাদের জমি নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আলাউদ্দিন খাঁর বসত ভিটার ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। সময়ের বিবর্তনে ওই ভিটা অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। জমি নিয়ে স্বজনদের মাঝে দ্বন্দ্ব থাকায় তাঁর জন্মস্থান শিবপুরে তেমন কিছু করা সম্ভব হয়নি। সুরসম্রাটের জন্ম ভিটা সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি। আমরা শিগগিরই ওই বাড়িতে পরিদর্শনে যাবো এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।’
এদিকে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের স্মৃতি রক্ষার্থে সম্প্রতি এক বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। এ প্রকল্পের আওতায় আলাউদ্দিন খাঁর নামে তাঁর গ্রামে সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র করার কথা রয়েছে। তবে শিল্পকলা একাডেমির প্রকৌশলী সুখ দেব চন্দ্র দাস বলেছেন, ‘ওস্তাদের গ্রাম শিবপুরে গিয়ে জমি না পাওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’